দুর্নীতি অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতায় পরিচালিত হচ্ছে সুইড বাংলাদেশ
নিজস্ব প্রতিবেদক
১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, 10:47 PM
নিজস্ব প্রতিবেদক
১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, 10:47 PM
দুর্নীতি অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতায় পরিচালিত হচ্ছে সুইড বাংলাদেশ
সোসাইটি ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অব দ্য ইনটেলেকচুয়ালি ডিজ এবল্ড বাংলাদেশ সংক্ষেপে সুইড বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৭ সালে। স্নায়ু বিকাশ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সমাজে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক, কর্মসংস্থান, পুনর্বাসন, আত্মনির্ভরশীল ও অধিকার আদায়ের নিমিত্তে কাজ করার ভিশন নিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় সুইড বাংলাদেশ।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধীরে ধীরে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা আর অনিয়মের আখড়া খানায় পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। মূলত স্বৈরাচার সরকারের মদদ পুষ্ট কতিপয় সদস্যের স্বেচ্ছাচারিতা আর অনিয়ম দুর্নীতির কারণেই এরকম একটি মহতী প্রতিষ্ঠান কলুষিত হয়ে উঠেছে।
প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম দুর্নীতির তথ্য পর্যালোচনায় একাধিক বিষয় সামনে আসে প্রতিবেদকের কাছে। তার মধ্যে অন্যতম একটি সুইড বাংলাদেশের মেন্টর পদ। প্রতিষ্ঠানটির গঠনতন্ত্রে সুনির্দিষ্ট ভাবে কোথাও মেন্টর পদের কোন উল্লেখ না থাকলেও এখানে মেন্টর হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত আছেন জওয়াহেরুল ইসলাম মামুন।যিনি সুইড বাংলাদেশে অলিখিত স্বৈরশাসক। যিনি প্রতিমাসে ৮০ হাজার টাকার বেতন উত্তোলন করেন। মূলত গঠনতন্ত্রে উল্লেখিত না হওয়ায় এই পদটি অবৈধ এবং বেতন উত্তোলনও অবৈধ হওয়ার কথা। এ বিষয়ে জওয়াহেরুল ইসলাম মামুন বলেন তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে মেন্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং প্রতি মাসে ৮০ হাজার টাকা বেতন উত্তোলন করেন। এ ধরনের দায়িত্ব পালন করতে প্রতিষ্ঠানটির গঠনতন্ত্র মতে সদস্যপদ স্থগিত করার বিধান থাকলেও মামুন তা করেননি বলে সুত্রমতে জানা যায়। এ বিষয়ে তার মতামত জানতে চাইলে তিনি সদস্যপদ স্থগিত করেছেন বলে দাবি করেন। এই প্রতিষ্ঠানে মেন্টর মামুন তার নিজস্ব আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার মানুষকে নিয়োগ দিয়ে আত্মীয়করণ করেছেন বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেন। তার স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে, চাকরি হারানোর ভয়ে কোন কর্মকর্তা, কর্মচারী মুখ খুলতে অস্বীকার করেন।
গত ১৯ মার্চ ২০১৯ তারিখে মো. লোকমান হোসেনকে ড্রাইভার হিসেবে ১৮ হাজার টাকা বেতনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ৩০ হাজার ২৩০ টাকা বেতনে তাকে চাকরিতে নিয়মিত করা হয়। তারপর ২৫ এপ্রিল ২০২১ তারিখে লোকমান হোসেন কে কেয়ারটেকার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
কেয়ারটেকার পদের জন্য নিয়োগ যোগ্যতা ন্যূনতম স্নাতক ও পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন কিন্তু লোকমানের এর কোন যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তাকে প্রমোশন দেওয়া হয় যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অবৈধ বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। স্বৈরাচার সরকারের মদদপুষ্ট লোকমান অফিসের অধিকাংশ লোকের সাথে অসাদাচরণ করে থাকেন বলে অভিযোগ উঠেছে। লোকমানের সকল দূর্নীতির প্রশ্রয়দাতা মেন্টর জওয়াহেরুল ইসলাম মামুন ও মহাসচিব মাহবুবুল মনির।
সুইড বাংলাদেশের বর্তমান মহাসচিব মাহবুবুল মনির এককভাবে প্রতিষ্ঠানটিতে তার আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছেন এবং তার খারাপ আচরণের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির ক্রয় সংক্রান্ত একটি ক্রয় কমিটি ২০২২ সালের শেষের দিকে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে বিলুপ্ত করেন মহাসচিব মনির এবং মেন্টর মামুন। লোকমানের মাধ্যমে মেন্টর ও মহাসচিব সকল আর্থিক অনিয়ম করে থাকেন বলে সুইড অফিসের পিয়ন থেকে কর্মকর্তা সকলের ভিতরে ক্ষোভ আছে। মেন্টর কতৃক চাকরি হারানোর ভয়ে অফিসের কেউ মুখ খুলতে চান না। মাহবুব মনির একই সাথে সুইডের ধানমন্ডি শাখার সভাপতি, প্রতিবন্ধী ফোরামের ভাইস প্রেসিডেন্ট, কেয়ারাসসের সভাপতি এবং সুইড বাংলাদেশের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন যা প্রতিষ্ঠানটির গঠনতন্ত্রের পরিপন্থী এবং একাধিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে সুইড বাংলাদেশের মতো মানবিক সংগঠনে সময় দিতে পারেন না, কখনোই তিনি সময়মতো অফিস করেন না।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, তিনি সরকারী মিটিং অংশ নেয়ার কথা বলে ব্যক্তিগত ব্যবসায় সময় দেন আর সুইড অফিস মূলত মেন্টর মামুন চালান। সুইডের প্রেসিডেন্ট ফরিদ আহমেদ অফিস পরিবহনের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে ৩৪ লাখ টাকা মূল্যের একটি মাইক্রোবাস অনুদান হিসেবে প্রদান করেন যার নাম্বার ঢাকা মেট্রো চ-৫৬-৩৯০৪। মাইক্রোবাসটি অফিসের কাজে ব্যবহৃত হওয়ার কথা থাকলেও মূলত মহাসচিব এককভাবে তার নিজের মতো করে ব্যবহার করেন এমনকি তার ছেলের বিয়েতেও এই গাড়ি ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছেন বলে জানা যায়।
মূলত ফ্যাসিস্ট সরকারের মদদপুষ্ট ছিলেন মহাসচিব মাহবুবুল মনির যে কারণে তার এই প্রভাব বিস্তার বলে অনেকের অভিমত। এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে তার মুঠোফোনে ফোন করা হলে তিনি নামাজের কথা বলেন পরবর্তীতে আবারো ফোন দেয়া হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
সুইড বাংলাদেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফরিদ আহমেদ সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করার জন্য পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলে জানা যায়। গুঞ্জন উঠেছে সুইডের অভ্যন্তরীণ অনিয়ম, দূর্নীতি, আত্মীয়করণ, মেন্টর ও মহাসচিবের স্বেচ্ছাচারিতার জন্যই সভাপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বিশ্বস্ত সূত্রে আরও জানা যায়, প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যে সুইড বাংলাদেশকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা অনুদান প্রদান করেন। তার অনুদানকৃত টাকার সঠিক ব্যবহার হয় না বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এমনকি তার অনুদানকৃত গাড়ি সম্পর্কিত বিভিন্ন অনিয়মের তদন্তও হয় সুইড বাংলাদেশে। এসকল বিষয়ে সভাপতির সাথে কথা বলতে তার মুঠোফোনে একাধিক বার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
সুইড বাংলাদেশ অফিস থেকে এবং অভিভাবকদের পক্ষ থেকে জানা গেছে, মেন্টর মামুন ও মহাসচিব মনির এর সকল অপকর্ম আড়াল করে এই দুষ্ট চক্রকে রক্ষা করতে সুইড বাংলাদেশের সহসভাপতি মো. শাহ আলম, সাংস্কৃতিক সচিব রাশিদা জেসমিন রোজী, ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরী, মাকসুদ শিকদার, যুগ্ম সচিব ইমেলদা হোসেন, অর্থ সচিব জোবায়েদুর রহমান মিলন, মো. সেলিম, ফকির মো. সোহেল সহ কয়েকজন অফিস কর্মকর্তা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তাদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করো হলে, তারা কেউ কেউ বিষয়গুলো পাশ কাটিয়ে যান এবং অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন, কয়েকজনের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে একাধিকবার কল করলেও উনারা রিসিভ করেননি।
সহসভাপতি মো. শাহ আলম এর বিরুদ্ধে একাধিক দূর্নীতির অভিযোগ আছে। রাজধানীর স্বনামধন্য বিদ্যালয় উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল থেকে তাকে দূর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরবর্তীতে তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ফ্যাসীবাদ শেখ হাসিনার মদদপুষ্ট হয়ে আবারও ঐ প্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদ নেন এবং তার বিরুদ্ধে অনিয়ম, চাকরি বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্যর অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকদের পক্ষ থেকে। তিনি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের নেতা ডা. ইকবাল প্রতিষ্ঠিত ভৈরবে একটি কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানেও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও বিগত সরকারের আমলে সুইড বাংলাদেশ পরিচালিত কলেজ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন মো. শাহ আলম। এই কলেজে সারা বাংলাদেশ থেকে শিক্ষকরা বিএসএড ডিগ্রি নেয়ার জন্য আসেন, এখানে প্রচুর আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আছে শাহ আলমের বিরুদ্ধে।
সাংস্কৃতিক সচিব রোজীর সাথে যোগাযোগ করা হলে উনি কোন প্রশ্নের সঠিক তথ্য দেননি। উনার ছোট ছেলের শ্বশুর তৎকালীন ফ্যাসীবাদ আওয়ামী সরকারের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। যার পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। রোজী ম্যাডাম সুইড ভকেশনাল স্কুলের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। উক্ত স্কুলের অভিভাবকদের অভিযোগ, স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকা রোজীর সহযোগিতায় সকল অনিয়ম করে থাকেন।
অভিভাবক, ছাত্রদের সাথে খারাপ ব্যবহার, উপরি টাকা, বাড়তি টাকা দেন যে সকল অভিভাবক সেসব ছাত্রদের সুযোগ সুবিধা দেয়া, আর্থিক অনিয়ম করে থাকেন প্রধান শিক্ষক কনা, পরিচালক রোজী আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে।
ভকেশনাল স্কুলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিভাবক ও শিক্ষকরা আর্থিক অনিয়মের বিষয় প্রকাশ করেন। একাধিক অভিভাবক বলেন, তারা বারবার বিচার দিয়েও শিক্ষিকা রোজী, মেন্টর, মহাসচিবের কাছে কোন সুরাহা পাননি। উপরন্ত অনেকে তাদের সন্তানকে স্কুলে আনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। আরো অভিযোগ আছে, শিক্ষিকা রোজীর ব্যক্তিগত সহকারী, এমনকি তার বাসার সহকারী হিসেবেও এই প্রধান শিক্ষক কনাকে তিনি ব্যবহার করেন। এই বিষয়ে উক্ত স্কুলের দুইজন শিক্ষক নাম না প্রকাশের শর্তে শিক্ষিকা রোজী বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ সত্যি বলে স্বীকার করেন। চাকরি হারানোর ভয়ে তারা মুখ খুলতে চান না কারণ এই প্রধান শিক্ষক কনা সুইডের মেন্টর মামুন সাহেবের কন্যা হিসেবে পরিচয় দিয়ে চাকরি করছেন। (বিস্তারিত ২য় পর্বে)